মার্কসের রাষ্ট্রতত্ত্ব সমালোচনাসহ আলোচনা করো ।

I will creat this page became  more templates tryal for preview.
1

5. মার্কসের রাষ্ট্রতত্ত্ব সমালোচনাসহ আলোচনা করো ।

Ans. রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে মার্কসবাদী চিন্তাধারা আদর্শবাদ বা উদারনীতিবাদ থেকে স্বতন্ত্র । মার্কসবাদীরা রাষ্ট্র সম্পর্কে যে বক্তব্য রেখেছেন, তা শুধু এসব মতবাদ থেকে পৃথকই নয়, একেবারে বিরুদ্ধ মতবাদ । মার্কসবাদ রাষ্ট্রকে শ্রেণির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছে । রাষ্ট্র সাধারণভাবে থাকতে পারে না, রাষ্ট্রের অর্থই হল নির্দিষ্ট সমাজব্যবস্থায় নির্দিষ্ট শ্রেণির স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার স্বরূপ ।

     মার্কস কোথাও স্বতন্ত্রভাবে রাষ্ট্র সম্পর্কে সুসংবন্ধ আলোচনা করেননি । তবে ধনতান্ত্রিক সমাজের সমালোচনা করতে গিয়ে পাঁচটি গ্রন্থে অতিসংক্ষিপ্তাকারে হলেও রাষ্ট্র সম্পর্কে আলোচনা করেছেন । এগুলি হল – “ক্রিটিক অফ হেগেলস ফিলসফি অফ রাইট’ , ‘দি ক্লাস স্ট্রাগেলস ইন ফ্রান্স’ , ‘দি সিভিল ওয়ার ইন ফ্রান্স’ , ‘এইটিনথ ব্লুমেয়ার’ , ‘ক্রিটিক অফ দি গোথা প্রোগ্রাম’ । এঙ্গেলস তাঁর “দ্য অরিজিন অব্ দি ফ্যামিলি, প্রাইভেট প্রপার্টি অ্যান্ড দি স্টেট, অ্যান্টি ড্যুরিং” প্রভৃতি গ্রন্থে ও প্রবন্ধে রাষ্ট্র সম্পর্কে আলোচনা করেছেন ।


 রাষ্ট্রের উৎপত্তি :   মার্কসবাদ অনুসারে, রাষ্ট্র চিরকাল ছিল না । সমাজের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় । এমন একটি সময় ছিল যখন সমাজে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল না কারণ, রাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়ার কোনো বস্তুগত শর্তই ছিল না । এই সময়কে বলা হয় আদিম সাম্যবাদী যুগ ।

      রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে সমাজের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক নির্দিষ্ট কালপর্বে মানুষের সামাজিক বিকাশের মধ্য দিয়েই । আদিম কমিউন ( সাম্যবাদী ) ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পর সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি সৃষ্টি হয় আর সমাজ হয়ে যায় শ্রেণিবিভক্ত । ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষার প্রয়োজনে একটি সংগঠনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে । এই সংগঠন সম্পত্তিশালী ব্যক্তিদের বা শ্রেণির শ্রেণিস্বার্থ রক্ষা করবে এবং অপরাপর শ্রেণি বা শ্রেণিগুলির ওপর শোষণ চালানোর মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে । এই সংগঠনটিই হল রাষ্ট্র ।

      রাষ্ট্র তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি হল আইন - আদালত, শাসনবিভাগের শ্রেমিকর্তাগণ, আইন প্রণয়নকারী ও রাজনীতিবিদগণ । অর্থাৎ, রাষ্ট্রের উৎপত্তি শ্রেণির উৎপত্তির সঙ্গে যুক্ত ।


 ইতিহাসে রাষ্ট্রের বিভিন্ন রূপ :-   মার্কসবাদীদের মতে, ইতিহাসে পাঁচ ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থা বা রূপ লক্ষ করা যায় (A) আদিম সাম্যবাদী রাষ্ট্র ; (B) দাস সমাজের রাষ্ট্র ; (C) সামন্ত সমাজের রাষ্ট্র ; (D) বুর্জোয়া সমাজের রাষ্ট্র ও (E) সমাজতান্ত্রিক সমাজের রাষ্ট্র বা প্রোলেতারিয়েতের একনায়কত্ব ।


 (A) আদিম সাম্যবাদী রাষ্ট্র :-   আদিম সাম্যবাদী রাষ্ট্রে কোনো শ্রেণি-ভেদ ছিল না । সকলেই ছিল সমান মর্যাদার অধিকারী । সকলেই সমানভাবে সমস্ত কিছু ভোগ করতে পারত । ফলে রাষ্ট্রেরও কোনো অস্তিত্ব ছিল না ।

 (B) দাস সমাজের রাষ্ট্র :-   দাস সমাজের রাষ্ট্র ছিল দাসমালিকের রাষ্ট্র ; এটি ছিল দাসশ্রেণির বিরুদ্ধে পরিচালিত রাষ্ট্র । রাষ্ট্রের আইন, বিচার বিভাগ, সেনাবাহিনী সবই ছিল । মালিকের পক্ষে, দাসদের কোনো অধিকার ছিল না ।

 (C) সামন্ত সমাজের রাষ্ট্র :-   সামত্ত সমাজের রাষ্ট্র ছিল ভূমি-দাসদের বিরুদ্ধে । এখানে রাষ্ট্র হল ভূমিমালিক বা সামন্তপ্রভুদের স্বার্থরক্ষাকারী রাষ্ট্র । এই রাষ্ট্রেও ভূমিদাসদের কোনো অধিকার বা স্বাধীনতা ছিল না রাষ্ট্রের আইনও ছিল সামন্তদের পক্ষে ।

 (D) বুর্জোয়া সমাজের রাষ্ট্র :-   বুর্জোয়া সমাজের রাষ্ট্র শ্রমিক শ্রেণিকে শোষণ এবং বুর্জোয়া শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে । এখানে সাধারণ জনগণের রাজনৈতিক অধিকার থাকলেও অর্থনৈতিক অধিকার থাকে না ।

 (E) সামন্ততান্ত্রিক সমাজের রাষ্ট্র :-   বুর্জোয়া শ্রেণি ও শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজতান্ত্রিক সমাজের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয় । এখানে সর্বহারার শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় । এই সমাজে শ্রেণিভেদ থাকে না, ফলে শ্রেণিশোষণও থাকে না ।



বুর্জোয়া রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কস :-   ইতিহাসে বুর্জোয়া সমাজ এক নতুন ধরনের সমাজব্যবস্থার পত্তন করে এবং অন্যান্য সমাজব্যবস্থার থেকে এটি গুণগতভাবে ভিন্ন প্রকৃতির । তবে এই ব্যবস্থা ও শ্রেণিরাষ্ট্রকে ‘বুর্জোয়া বিষয়াবলি চালানোর কমিটিমাত্র’ বলে মার্কস উল্লেখ করেছেন ।

     তবে এই রাষ্ট্রও কাজ করে শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার জন্য । পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের আধিপত্য থাকে পুঁজিপতিশ্রেণির হাতে, কারণ যারা অর্থনৈতিক উৎপাদনকে নিয়ন্ত্রণ করে তারাই রাজনীতিকেও নিয়ন্ত্রণ করে । এটি হল, শ্রমিক ও অপরাপর শ্রেণির ওপর শোষণ চালানোর যন্ত্র ।


  ভিত্তি ও উপরিকাঠামো :-    মার্কসবাদ অনুসারে অর্থনীতি হল সমাজের ভিত্তি । অর্থনীতির ওপর ভিত্তি করে সামাজিক সম্পর্ক; সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, শিক্ষামূল । ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলি; আইন, শাসন । বিচারবিভাগ ; পুলিশ প্রশাসন প্রভৃতি গড়ে উঠেছে । এগুলি হল উপরিকাঠামো ( Super structure ) ।


 বলপ্রয়োগ ও সম্মতি :-   বুর্জোয়া রাষ্ট্র উপরিকাঠামোর অংশ হিসেবে যে সব সময়ে বন্দুক ব্যবহার করে তা নয় । আন্তোনিও গ্রামশি বুর্জোয়া রাষ্ট্রের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লিখেছেন, State is force + consent । অর্থাৎ, রাষ্ট্র হল বলপ্রয়োগ ও সম্মতি । সাধারণ অবস্থায় রাষ্ট্র চলতে চেষ্টা করে জনগণের সম্মতি নিয়ে, কিন্তু প্রয়োজন হলে রাষ্ট্র বলপ্রয়োগে পিছপা হয় না ।


রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধীনতা : মার্কসীয় রাষ্ট্রতত্ত্ব বিশ্লেষণের আর - একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল রাষ্ট্রে র আপেক্ষিক স্বাধীনতার প্রশ্ন । সাধারণভাবে রাষ্ট্র হল শাসক ও শোষকশ্রেণির যন্ত্র । সেই হিসেবে রাষ্ট্রের কোনো স্বাধীনতা নেই । কিন্তু ইতিহাসের বিশেষ কালপর্বে রাষ্ট্র স্বাধীন বা স্বতন্ত্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে ।


সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা : -   এ রাষ্ট্রের কাজ দুটি— শোষকশ্রেণি বা বুর্জোয়াদের অবশিষ্টাংশকে বাতিল করা বা ধ্বংস করা এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বৈষয়িক ও সাংস্কৃতিক নির্মাণ করা । দ্বিতীয়, এই রাষ্ট্র ক্ষমতাচ্যুত শোষকদের বিরুদ্ধে একনায়কতন্ত্র এবং শ্রমিকশ্রেণি ও অন্যান্য সহযোগী শ্রেণির বিরুদ্ধে গণতন্ত্র গড়ে তোলে ।

    লেনিনের মতে এটি হল সব থেকে উন্নত গণতন্ত্র । এই রাষ্ট্রের কাজ হল রাষ্ট্রকেই অপ্রয়োজনীয় করে দেওয়া । এঙ্গেলস - এর মতে এই রাষ্ট্রকে ধ্বংস করতে হবে না, এটি অবলুপ্ত হবে । যখন শ্রেণি থাকবে না, শহর ও গ্রামের পার্থক্য থাকবে না, কায়িক শ্রম আর মানসিক শ্রমের পার্থক্য ঘুচে যাবে, মানুষ বিচ্ছিন্ন থাকবে না, স্বশাসনের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে, রাষ্ট্র তখন জায়গা নেবে সংগ্রহশালায় ।



 সমালোচনা :-
     প্রথমত,
 রাষ্ট্র সব সময় শোষণে সাহায্য করে তা নয়, রাষ্ট্র শোষণের বিরুদ্ধেও কাজ করে ।


      দ্বিতীয়ত,
 আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বহুমাত্রিক চরিত্রকে ব্যাখ্যা করতে মার্কসবাদ অসমর্থ হয়েছে ।


     তৃতীয়ত,
 প্রোলেতারিয়েতের একনায়কত্ব শেষ পর্যন্ত পার্টির একনায়কত্ব ও পরে ব্যক্তির একনায়কত্বে পরিণত হতে পারে ( যেমন — সোভিয়েত ইউনিয়ন ) ।


     চতুর্থত,
 প্রোলেতারিয়েতের একনায়কত্ব থেকে সাম্যবাদে উত্তরণ নাও ঘটতে পারে । তিনি রাষ্ট্রের অবলুপ্তির ধারণাকে myঔopia of history ( ইতিহাসের ঝাপসা বিষয় ) বলে অভিহিত করেছেন ।


     পঞ্চমতম,
 রাষ্ট্র ছাড়া সমার্জ কেমন করে চলবে তা মার্কসবাদীগণ দেখাতে পারেননি ।


মূল্যায়ন/উপসংহার :-  সমালোচনা সত্ত্বেও এ কথা বলা যায় যে, মার্কসবাদের আলোকে রাষ্ট্রের প্রকৃত চরিত্র বোঝা সম্ভব । অধ্যাপক ল্যাস্কি তাঁর ‘দি স্টেট ইন থিয়োরি অ্যান্ড প্র্যাকটিস’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, অন্য কোনো তত্ত্ব মার্কসবাদের মতো রাষ্ট্রে র যথার্থ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে পারেনি ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1মন্তব্যসমূহ

Thank you. We will try to come up with more questions for you very soon.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন