সর্বোদয় সম্পর্কে গান্ধিজির ধারণার মূল্যায়ন করো ।

0

10. সর্বোদয় সম্পর্কে গান্ধিজির ধারণার মূল্যায়ন করো ।

Ans. ভারতের রাষ্ট্রদর্শনের ইতিহাসে মহাত্মা গান্ধি, প্রচলিত অর্থে প্লেটো, অ্যারিস্টট্ল, মিল প্রমুখের মতো রাষ্ট্র বিজ্ঞানী ছিলেন না । গান্ধিজির সমগ্র চিন্তা – কর্ম, ধর্ম ও মানবতাবোধের দ্বারা পরিচালিত ছিল । সত্য ও অহিংসা (Truth and Non - violence) এই দুটি প্রধান আদর্শ তাঁর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক মতাদর্শকে নিয়ন্ত্রণ করেছে ।

চিন্তার উৎস :-   গান্ধিজির চিত্তা ও ধর্ম – বেদ, গীতা, বাইবেল, কোরান, বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্মের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত । 1909 খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘হিন্দ স্বরাজ’ নামক গ্রন্থে মহাত্মা গান্ধির রাষ্ট্রচিন্তার কয়েকটি দিক পরিলক্ষিত হয় ।

    গান্ধিজি মনে করেন যে, এই সমাজ হবে সাম্যভিত্তিক । প্রতিটি মানুষ শ্রম ও সহযোগিতার মধ্য দিয়ে সামগ্রিক কল্যাণে উদগ্রীব হবে । প্রতিটি ব্যক্তির কর্মের মর্যাদা এক হবে । সমস্ত জাতি ও শ্রেণির সার্বিক বিকাশ ঘটবে । এই কাল্পনিক অবস্থাকে তিনি সর্বোদয় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন । সর্বোদয়ের অর্থ হল— সবার উন্নয়ন (Uplift of all) । এই রাষ্ট্রবিহীন সমাজ বা গণতন্ত্রকে তিনি রামরাজ্য (Kingdom of God) আখ্যা দিয়েছেন ।


     গান্ধিজির ওপর রাস্কিন -এর ‘আনটু দিস লাস্ট’ গ্রন্থটির প্রভাব সুস্পষ্ট । গান্ধিজি নিজে স্বীকার করেছেন – That book marked a turning point in my life.  1934 খ্রিস্টাব্দে তাঁর আত্মকথায় গান্ধিজি সর্বোদয়ের তিনটি সিদ্ধান্তের উল্লেখ করেছেন –

  (i) সমষ্টির কল্যাণের মধ্যেই ব্যক্তিকল্যাণ নিহিত;
  (ii) জীবিকা অর্জনের অধিকার সকলের সমান, তাই উকিল ও ক্ষৌরকারের কাজের মূল্য অভিন্ন;
  (iii) শ্রমভিত্তিক জীবনই হল সার্থক জীবন । কারণ, শ্রমের গুরুত্বই সর্বাধিক । [Sarvodaya, literally meaning the uplift of all is the most appropriate name of Gandhian Socialism.]



সমালোচনা :-   আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় গান্ধিকে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সমালোচনা করা হয় ।

    (i) গান্ধিজির রাষ্ট্রচিন্তা স্ববিরোধী । একদিকে তিনি রাষ্ট্রবিহীন সমাজের কথা কল্পনা করেন, অন্যদিকে তিনি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করেননি ।

   (ii) গান্ধিজি ব্যক্তিসত্তার ওপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন । ব্যক্তিকে সমাজ এবং রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন ।

   (iii) মহাত্মা গান্ধি রাষ্ট্রকে ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণের উপায় হিসেবে গণ্য করেন, কিন্তু মার্কসীয় দর্শন অনুযায়ী রাষ্ট্র হল শ্রেণিশোষণের যন্ত্র ।

   (iv) গান্ধিজি ধর্মকে রাজনীতির প্রাণ হিসেবে গণ্য করেন । কিন্তু মার্কসীয় দর্শন ধর্মকে আফিম হিসেবে গণ্য করে এবং ধর্মের ভূমিকা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে । এ ছাড়া গান্ধিজির কল্পিত ‘রামরাজ্য’ একটি অবাস্তব কল্পনামাত্র ।



মূল্যায়ন/উপসংহার :-
       উপরোক্ত সমালোচনা সত্ত্বেও নৈতিকতা ও রাজনীতির মধ্যে সমন্বয়সাধন, ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান – এই দিকগুলি ভারতীয় রাষ্ট্রদর্শনে মহাত্মা গান্ধির মৌলিক অবদান । প্রকৃতপক্ষে আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য বাস্তব কৌশলের পরিবর্তে গান্ধিজির চিন্তায় সামাজিক ও ধর্মীয় আদর্শ বেশি গুরুত্ব পেয়েছে । কিন্তু আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মত্যাগ, অহিংসা, সত্যাগ্রহ, সর্বোদয় ইত্যাদি মূল্যবোধের বাস্তব জীবনে কোনো স্থান নেই । তবে আধুনিক রাজনৈতিক তত্ত্বে আদর্শের প্রশ্নটি ভিত্তিহীন হলেও উন্নত সমাজ গঠনের জন্য ত্যাগ, নৈতিকতা, মূল্যবোধকে বর্জন করা যায় না । রাজনীতির সঙ্গে নৈতিকতা ও আদর্শের সমন্বয়ের মধ্যেই গান্ধিজির কৃতিত্ব নিহিত ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

Thank you. We will try to come up with more questions for you very soon.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)