গান্ধিজির রাষ্ট্রতত্ত্বের ধারণাটি ব্যাখ্যা করো ।

I will creat this page became  more templates tryal for preview.
0

7. গান্ধিজির রাষ্ট্রতত্ত্বের ধারণাটি ব্যাখ্যা করো ।

Ans. প্রচলিত অর্থে গান্ধিজি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ছিলেন না । প্লেটো, অ্যারিস্টট্ল, লক, রুশো, মার্কস যে অর্থে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, গান্ধিজি সে অর্থে রাষ্ট্র সম্পর্কে আলোচনা করেননি । ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্বে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে রাষ্ট্র, সরকার প্রভৃতি সম্পর্কে তিনি বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন । সেইসব মন্তব্যকে সুসংহতভাবে উপস্থিত করলে তাঁর রাষ্ট্রতত্ত্ব পাওয়া যায় । তবে তাঁর রাষ্ট্রতত্ত্বের ধারণা ‘হিন্দ স্বরাজ’ গ্রন্থে সুসংহত রূপে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ।

      টলস্টয়ের ‘দি স্লেভারি অব্ আওয়ার টাইমস’ গ্রন্থটির দ্বারা গান্ধিজি গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন । কারণ, এই গ্রন্থেই টলস্টয় রাষ্ট্রকে হিংসা ও বলপ্রয়োগের বৈধ যন্ত্র হিসেবে বর্ণনা করেছেন । রাষ্ট্র হল দাসত্ব, বন্ধনের যন্ত্র । আইন সেই বন্ধনদশাকে টিকিয়ে রাখে । গান্ধিজি টলস্টয়ের বক্তব্য অনেকটাই মেনে নিয়েছেন ।


 রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে গান্ধিজির মত :-  গান্ধিজি ছিলেন অহিংসার পূজারি । রাষ্ট্রের প্রকৃতি অন্যান্য সামাজিক সংগঠন থেকে যে পৃথক ধরনের, তা তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি । তাঁর মতে— 

  (i) রাষ্ট্র অশুভ ও হিংসার প্রতীক :   রাষ্ট্র গান্ধিজির চোখে অশুভ প্রতিষ্ঠান । তিনি মনে করেন যে, রাষ্ট্রের অর্থই হল ক্ষমতা । এটি দমন ক্ষমতা বা শারীরিকভাবে নির্যাতন করার ক্ষমতা । রাষ্ট্রের এই ক্ষমতা অপ্রতিহত ও অপ্রতিরোধ্য । তাঁর মতে, রাষ্ট্র হিংসার ওপর প্রতিষ্ঠিত । সুতরাং, রাষ্ট্র মূলত পীড়ন মূলক ও শোষণ মূলক প্রতিষ্ঠান ।

  (ii) রাষ্ট্র ও বলপ্রয়োগ :  গান্ধিজি রাষ্ট্রকে দার্শনিক, নৈতিকতা ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সবদিক থেকেই সমালোচনা করেছেন । গান্ধিজির যুক্তি হল, ভালো সবকিছুই আসে বিবেক ও চেতনা থেকে । রাষ্ট্র সেই চেতনা ও বিবেককে ধ্বংস করে । বলপ্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্র ব্যক্তিমানুষের ব্যক্তিত্বের বিনাশ করে ।

 (iii) রাষ্ট্র ও ব্যক্তির বিরোধ :   মার্কস বলেন, ব্যক্তির কাজ হল নিজের প্রতি সৎ থাকা । ‘হিন্দ স্বরাজ’ -এ তিনি লিখেছেন – আমরা যদি আমাদের বিবেকের বিরুদ্ধে কোনো আইনকে মান্য করি, তাহলে সেটি হবে মনুষ্যত্ববিরোধী ।

     অন্যায় আইনও মান্য করা উচিত – এই সংস্কার যতদিন না দূর হচ্ছে ততদিন দাসত্বের অবসান হবে না । তিনি রাষ্ট্রকে কখনোই ‘নিজেই নিজের লক্ষ্য’ বলে মনে করতেন না ।

 (iv) সমাজ ও রাষ্ট্র :   গান্ধিজির মতে, রাষ্ট্রের প্রতি ব্যক্তির বেশি আনুগত্য প্রদর্শন করার প্রয়োজন নেই । এদিক থেকে গান্ধিজি রবীন্দ্রনাথের মতোই সমাজকে রাষ্ট্রের ওপরে স্থান দিয়েছেন । কার্ল মার্কসও রাষ্ট্রকে কখনোই সমাজের ওপরে স্থান দিতে রাজি ছিলেন না ।

  (v) রাষ্ট্রের কাজ হবে সীমিত :   গান্ধিজি রাষ্ট্রের কাজের বিস্তৃতি চাননি । তাঁর মতে, সেই রাষ্ট্রই ভালো যা সব থেকে কম শাসন করে । রাষ্ট্রের অধিকাংশ কাজকে তিনি স্বেচ্ছামূলক প্রতিষ্ঠানগুলির হাতে দেওয়ার কথা বলেন । তবে তিনি একথা মেনে নিয়েছেন যে, এমন কতকগুলি কাজ বা বিষয় আছে যেগুলি রাজনৈতিক ক্ষমতা ছাড়া করা সম্ভব নয়,  তবে রাষ্ট্রের উচিত কম শক্তি প্রয়োগ করে কাজ করা ।

(vi) রাষ্ট্রবিহীন গণতন্ত্র :   রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্রই গান্ধিজির আদর্শ, এটি হল সর্বোদয় সমাজ, রামরাজ্য বা জ্ঞানদীপ্ত নৈরাজ্য । এই ব্যবস্থার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে—

     1. এই ব্যবস্থার দার্শনিক ভিত্তি হবে অহিংসা ।

     2. এখানে সততা , ন্যায় , সাম্য ও সুখ বিরাজ করবে ।

     3. রাষ্ট্র এই সমাজে থাকবে তবে তার কাজ হবে ন্যূনতম । কতকগুলি প্রতিষ্ঠান যেমন – সেনাবাহিনী, পুলিশ, আমলাতন্ত্র, দালত, বৃহৎ শিল্প ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, বড়ো বড়ো হাসপাতাল ও ভারী ভারী যন্ত্রপাতি কাজ করবে । ব্যক্তিত্ব বিনাশের জন্য নয়, সাধারণের মঙ্গল করার জন্য ।

    4. জনগণের সার্বভৌমিকতা নৈতিক শক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে, এবং রাষ্ট্র থাকলেও সে তার হিংসামূলক চরিত্র হারিয়ে ফেলবে ।

    5. বিকেন্দ্রীকরণের ওপর এই সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে । এখানকার জীবন হবে স্বয়ংক্রিয় । কেউ কারও ওপর আধিপত্য দেখাবে না । সকলের জন্য একই রকম স্বাধীনতা থাকবে । প্রত্যেকে নিজেই হবে নিজের প্রভু ।



 সমালোচনা :-   গান্ধিজির রাষ্ট্র বিষয়ক ধারণা যথেষ্ট সমালোচিত হয়েছে ।

    প্রথমত,
 মার্কসবাদীদের মতো রাষ্ট্রকে শোষণের যন্ত্র বলেছেন । কিন্তু রাষ্ট্র কেন হিংসা প্রয়োগ করে, কোন্ শ্রেণির রাষ্ট্র অত্যাচার - অবিচার করে, তার কথা বলেননি ।

    দ্বিতীয়ত,
 রাষ্ট্রের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি শুধু রাষ্ট্রের সমালোচনা করেছেন । রাষ্ট্র যে জনকল্যাণও করে সে সম্পর্কে বিস্মৃত হয়েছেন গান্ধিজি ।

    তৃতীয়ত,
 রাষ্ট্রের সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি ব্যক্তিকেই সার্বভৌম করে তুলেছেন । ব্যক্তিকে সমাজের ওপরে স্থান দিয়েছেন । কিন্তু ব্যক্তি সমাজের ঊর্ধ্বে নয় ।

   চতুর্থত,
 তিনি একবার রাষ্ট্রকে সমালোচনা করেছেন, আবার কখনও রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছেন । অর্থাৎ তাঁর তত্ত্ব স্ববিরোধী ।

   পঞ্চমত,
 গান্ধিজি ভবিষ্যৎ সমাজের চিত্র অঙ্কন করতে গিয়ে প্রাচীন বা আদিম কৃষিনির্ভর সভ্যতার চিত্র এঁকেছেন । এ তো ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা নয়, অতীতের দিকে প্রত্যাবর্তন ।



 মূল্যায়ন/উপসংহার :-     সমালোচনা সত্ত্বেও গান্ধিজির রাষ্ট্রচিন্তা আজও গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হয়ে চলেছে । গান্ধিজি তাঁর রাষ্ট্র চিন্তায় অস্পৃশ্য, নীচ, দরিদ্র মানুষের মুক্তির কথা বলেছেন, যা অন্যান্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের তত্ত্বে পাওয়া যায় না । তাই কমিউনিস্ট নেতা ই. এম. এস. নাম্বুদ্রিপাদ বলেছেন মহাত্মা গান্ধিই হচ্ছেন ভারতের প্রথম জননেতা । গান্ধিজি বিকেন্দ্রীকরণ, পঞ্চায়েতিরাজ ব্যবস্থা, বুনিয়াদি ব্যবস্থা, সর্বোদয় ব্যবস্থা প্রভৃতি বিষয়সমূহ তাঁর রাষ্ট্রচিন্তায় অন্তর্ভুক্ত করে আলোচনা ক্ষেত্রের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

Thank you. We will try to come up with more questions for you very soon.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)